মৌলভীবাজার জেলা প্রতিনিধিঃ-মৌলভীবাজার জেলায় প্রায় ৯০ টির ও বেশি ক্ষুদ্র নৃ-জাতি গোষ্ঠীর বসবাস। স্থানে রয়েছে খাসিয়া বা খাসি সম্প্রদায়। দুটি গ্রামে বসবাস করেন মণিপুরি সম্প্রদায়। প্রায় ৫টি রিমোট এলাকায় বসবাস করেন ত্রিপুরা সম্প্রদায়, চা বাগানের উঁচু ও রিমোট এলাকায় বসবাস করেন গারো, ওঁরা/ উরাং , সাঁওতাল, মুন্ডা, মালপাহাড়ী, পাহাড়ি, কোল বা কল, হাজং, কন্দ, কড়া বা মুদি, গন্জু, গড়াইত, তেলী, তুরি বা মিধা, পাত্র, বাগতী বা বাকতি, বড়াইক বা বাড়াইক, ভূমিজ, মালো বা ঘাসিমালো, মাহালি, মুসহর বা রিকিয়াস, রাজুয়ার, লোহার বা কর্মকার, শবর, খারিয়া, খেড়োয়ার, তংলা, ভিল বা ভীম শহরা বা তেলেঙ্গা, ভূইমালী বা ভূঁইয়া, পাঙন (মণিপুরী মুসলিম), এ ছাড়াও চাকমা, বর্মণ বা কোর,জাতি শহর এলাকায় বসবাস করেন।
এসব আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে কথা বলে জানাযায়, তারা যে সকল জায়গায় বসবাস করেন তা এক সময় ঘন জঙ্গল ছিলো। বনের হিংস জীবযন্তুর সাথে লড়াই করে তাদের পূর্বপুরষরা এখানে বসতি স্থাপন করেন। নিয়ন্ত্রিত রাজ্যব্যবস্থাপনা বা সরকার থেকে তারা অনেকটা দূরে থাকতেন। বসতির আসে পাশে বিভিন্ন ফসলের জুম চাষ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু যুগ পাল্টেছে। দেশে মানুষ বেড়েগেছে।
বন জঙ্গল উজার হতে হতে পিঠ টেকেছে দেয়ালে। যে টুকুই আছে তা আবার তৎকালীণ বিট্রিশ সরকারের সময থেকেই লিজ দেয়া শুরু হয় চা বাগান হিসেবে। তাদের বসবাসকৃত জমি অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের নিজের নামের রেকর্ড পত্র না থাকায় এটি খাস খতিয়ানের অর্ন্তভুক্ত। আর খাস জমি হিসেবে তা লিজ পেয়ে যান চাবাগান মালিক ও কোম্পানীসহ অনান্য প্রভাবশালীরা। লিজ পাওয়া চা বাগান কর্তৃপক্ষ এটি দখলে বা চাষাবাদে এসে তারা দেখতে পান তাদের লিজনেয়া অনেক জমি আদিবাসীদের দখলে।
তারা পান ও জুম চাষ করে এখানে বসবাস করছেন। এ সময় বাগান মালিক ও আদিবাসীদের মধ্যে শুরু হয় বিবাধ। ছোট ছোট পরিসরে যারা ছিলেন তারা অনেকেই জমি ছেড়ে বাগানে কাজ নিয়ে জীবিকার পথ পরিবর্তন করেন। আর সংঘবদ্ধ অনেকেই যারা পান চাষ করে জীবিকা নিবার্হ করেন তাদের কেউ কেউ বাগান কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সাব লিজ নিয়ে বসবাস করতে শুরু করেন। এভাবে অন্যের লিজ নেয়া পাহাড়ী জমিতে বসবাস করে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে।
বৃহত্তর সিলেট আদিবাসী ফোরামের সভাপতি পিডিসন প্রধান সুচিয়াং বলেন, ভূমিহীন হিসাবে পরগাছার মতো বসবাস করায় তাদের দিন কাটে উচ্ছেদ আতংকে। অথচ তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পাশাপাশি তাদের উৎপাদিত পণ্য আজ দেশের বাজার ছাড়িয়ে রপ্তানী হচ্ছে ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্যে। অন্যের লিজকৃত ভূমিতে সুস্বাদু সেই পান চাষ করে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাদের।
শ্রীমঙ্গল লাউয়াছড়া পুঞ্জি প্রধান পিলাপত্মী জানান, পাহাড়ের উপরে বসবাসকারী অধিকাংশ খাসিয়া পুঞ্জির নেই নিজস্ব কোন রাস্তা। অন্যের লিজকৃত চা বাগানের জমি ও লেবু আনারসের বাগানের মধ্যদিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করতে হয়। এনিয়ে বিভিন্ন সময়ে ছোটখাট সংঘাত সংঘর্ষ থেকে শুরু করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। সংঘাতে প্রাণও গেছে অনেকের। এছাড়াও বিশুদ্ধ পানির অভাব, স্যানিটেশন সমস্যা, শিক্ষা, চিকিৎসা ও যাতায়াত ব্যবস্থা সবকিছুতেই অনেক পিছিয়ে রয়েছে এ জনগোষ্ঠী।
আর তরুণ আদিবাসী নেতা সাজু মাচিয়াং জানান, তাদের নানান সমস্যা বিরাজমান থাকলে বর্তমান সরকার তাদের এই সমস্যা সমাধানে আন্তরিকতার সহিত অনেকগুলো কাজই সম্পাদনকরে দিচ্ছেন। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, কিছু কিছু পুঞ্জিতে উঠার জন্য সিঁড়ি তৈরী করে দেয়া, পাহাড়ী ছড়ার উপর বেশ কিছু কালভাট করে দেয়া, স্কুল তৈরীতে সহায়তা ও তাদের ভাষায় বই বিতরণসহ সরকারী অনান্য সুযোগ সুবিধাদি তারা পাচ্ছেন। এখন তাদের চাওয়া তাদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করা।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি নেছার উদ্দিন জানান, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বিষয়টি সরকার অনেক গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। শ্রীমঙ্গল উপজেলায় প্রায় ১২টি খাসিয়া পুঞ্জি, কয়েকটি ত্রিপুরা পল্লি, সাওতাল ও গাঢ় পল্লি রয়েছে। দুটি খাসি পুঞ্জির নামে রেকর্ড ভুক্ত জমিও আছে। তাদের জীবনমান উন্নয়নে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একজন সমন্বয়কও দেয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম জাবেদ জানান, বিগত কয়েক বছরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং মৌলভীবাজার জেলা ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন উনয়নমূলক কর্মকান্ডে উপজেলার ক্ষুদ্র নৃ-জাতি গোষ্ঠীর জীবনমানের দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়েছে।
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম জানান, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ক্ষুদ্র নৃ- জাতিগোষ্ঠী বিশেষ করে খাসি অধিবাসী দূর্গত ও প্রতন্ত এলাকায় বসবাস করেন। তাদের প্রত্যেকটি গ্রামই তিনি পরিদর্শন করেছেন এবং তাদের বিভিন্ন সমস্যা উপলব্দি করে ইতিমধ্যে তাদের জন্য ৩টি বড়সহ মোট ১৩টি ব্রীজ, ৭টি সিড়ি, উপড়ে উঠার জন্য ৩টি আরসিসি ঢালাই রাস্তা, প্রত্যেক পুঞ্জিতে বিদুত্যের ব্যবস্থা, স্কুল ভবন, স্কুলের আসবাব পত্র, তাদের ভাষায় বই বিতরণ, তাদের সন্তানদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আসার জন্য ২৩০টি বাই সাইকেল বিতরণসহ উল্লেখযোগ্যসক কাজ করা হয়েছে এবং অভ্যাহত আছে।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান জানান, ক্ষুদ্র নৃ- জাতিগোষ্টির বসবাসরত এলাকায় তাদের ভৌতিক উন্নয়নের পাশাপাশি তাদের জীবনমানের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। বিশেষ করে তাদের গুনগত মান উন্নয়নে সরকার উল্লেখযোগ্যসব কাজ করছে। তাদের ভূমি সমস্যার বিষয়ে তিনি জানান, যখনই ভূমি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয় সাথে সাথেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেখানে পৌছে তার সমাধান করা হয়। আর তাদের ভূমির স্থায়ী সমাধানের বিষয়টি একটি নীতি নির্ধারনী বিষয় যা ইতিমধ্যে উর্ধতন বিভাগকে অবগত করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার-৪ আসনের এমপি উপাধ্যক্ষ ড. মো: আব্দুস শহীদ জানান, ইতিমধ্যে এসব আদিবাসী দাবীদার অধিবাসীদের ক্ষুদ্র নৃ-জাতী গোষ্টি হিসেবে মুল্যায়ন করে তাদের জন্য প্রতন্ত এলাকায় বিদ্যালয় প্রতিষ্টা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের জন্য ললিতকলা একাডেমী স্থাপন, দূর্গম পাহাড়ে বিদুৎ, পানির ব্যবস্থা করা ও পাকা রাস্তার করে দেয়া হয়েছে। কিছু এলাকা বাকী রয়েছে যা প্রকৃয়াধিন। তাদেরকে বয়স্কভাতা, বিধবা ভাতা ও মাতৃত্বকালীন ভাতাসহ সরকারের সকল সুযোগ সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে। তিনি বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-জাতী গোষ্টির উপর তিনি গবেষনা করে পিএইচডি করেছেন। এর কারন হিসেবে তিনি জানান, এই জাতী গোষ্টির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছে। বিশেষ করে তাদের বসবাসের এলাকাগুলোর পরিবেশ খুবই সুন্দর। যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছে। আর এই জাতীগোষ্টির বিশাল একটি অংশ তার নির্বাচনী এলাকায় রয়েছে। তিনি জানান, সরকারীভাবে এখন পর্যন্ত ৩৭ টি নৃ-গোষ্টিকে সংরক্ষন করা হয়েছে কিন্তু তাঁর গবেষনায় শুধু মৌলভীবাজারে পাওয়া গেছে ৯০টি ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্টি। আর এর প্রত্যেকটি জাতী গোষ্টির ঐতিহ্য রক্ষায় সরকার বদ্ধ পরিকর।
আজ আদিবাসী দিবসে শিক্ষার উন্নয়নের পাশাপাশি আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতিসহ তাদের জন্য নিজস্ব ভুমিকমিশন চালুর দাবী জেলার খাসি আদিবাসী সম্প্রদায়।
কমেন্ট করুন